একান্ত আপন
মাস্কাট ডায়েরি
প্রথম পর্ব
মাস্কাট এই, মাস্কাট ওই বলে খুব তো বড়াই করি কিন্ত এখানে আসার পর দুটো বছর আমাদের ওপর দিয়ে যে কি ঝড় গেছে ,না বললেই নয়।
ইউ টিউব এও একজনের vlog এ শুনেছি বলতে যে কানাডা যাবার পর দুটো বছর খুব স্ট্রাগল গেছে।আসলে যে কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে সেখানে থিতু হতে সবাইকে না হলেও অনেক কেই বোধহয় কিছু যুদ্ধ করতে হয়েছে! আমার লেখা পড়ার পর আপনারাই বলবেন যে আমরাও কত কষ্ট করেছি!
আজ ২৭ নভেম্বর ২০২০। মাস্কাট এসেছি ১২ টা বছর কেটে গেছে।এখন আমরা নিজেদের আসল অস্তিত্ব কে হারিয়ে অনেক টাই এই দেশের হয়ে গেছি,যদিও জানি একদিন নিজের শেকড় এর টানে ফিরতে হবে।এটাই নিয়তি।
গালফ কান্ট্রি তে চাকরি হলে এমনটাই হয়।এখানে সবাই ভাড়া বাড়িতে থাকে,তারপর retire করে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।এখন যদিও কিছু কিছু প্রপার্টি তৈরী হচ্ছে foreiner দের জন্য,কিন্ত আমাদের মত সাধারণ চাকরি জীবি মানুষ জন সে সব কেনার কথা সপ্নেও ভাবতে পারি না।
এবার আসি আসল কথায়, মানে ফিরে দেখতে হবে সেই ২০০৮ এর দিন গুলো।আমি দুটো ছেলে মেয়ে কে নিয়ে একলা এসে পৌঁছলাম মাস্কাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ।বিদায় বেলায় মা কে জড়িয়ে একটু যে কান্নাকাটি করব তাও পারিনি কারণ আমায় একা দুটো বাচ্ছা নিয়ে বিদেশ যেতে হচ্ছে আর প্লেন এও চড়ব সেই প্রথম,তাই আনন্দের থেকেও ভয় পেয়েছি অনেক বেশী।সে যা হোক দুগ্গা দুগ্গা করে দিল্লী থেকে মাস্কাট তো এলাম।সব রকম ফর্মালিটি মিটিয়ে যখন বাইরে এলাম তখনও আমার বর airport এসে পৌঁছয়নি।তখন বেশ ভয় ভয় করছে ,আমার কাছে তো আর এ দেশের নম্বর এর কানেকশন নেই যে ওকে ফোন করবো।কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর ই পাঠানো একজন লোকের হাতে আমার নাম লেখা বোর্ড দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।আর তার ও একটু পরেই আমার হাজব্যান্ড ও এসে পড়েছিল।
আঃ! Airport থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাবার সময় এখানকার রাস্তা ঘাট দেখে বেশ ভালো লাগল।যদিও আমি দিল্লী থেকে এসেছিলাম বলে এরকম পরিষ্কার রাস্তা দেখে অবাক খুব একটা হইনি।সেই সময় সবাই এমন ভাবে দিল্লীর পরিষ্কার ঝকঝকে রাস্তা ঘাটের উদাহরণ দিত যে মনে হতো যেন অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থলের মত ওটা ও একটা দেখবার জিনিস।
একটা বিরাট গাড়ি গিয়েছিল আমাদের নিতে।আমার ছেলে তো খুব খুশী ,বাবা কে কতদিন বাদে কাছে পেয়ে! আর মেয়ে তো এত ছোটো যে তার তখন ও সেরকম বোধ বুদ্ধি হয়নি।আমাদের গন্তব্য স্থল ছিল ওদের অফিসের ই গেস্ট হাউস যেখানে আমরা থাকবো যতক্ষন না নিজেদের একটা ভাড়া বাড়ি পাচ্ছি।ওটা ২ বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট ছিল,কিন্ত সাইজ এ প্রকাণ্ড।বাথরুম ,রান্নাঘর সবার ই সাইজ এক একটা মাস্টার বেডরুম এর মত।আমার তো ভালো লাগল এই জন্য যে আমার বাচ্চারা একটু খেলার জায়গা পাবে এই ভেবে।
আমাদের ছাড়া ওর লাস্ট ৪ মাস যে কি ভাবে কেটেছিল পরে ওর মুখে সব শুনেছিলাম।কোনো কোনো রাতে শুধু মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে,কারণ তখন ও রান্না পারতো না।কিন্ত কিছু করার ও ছিল না কারণ মাস্কাট এর এটাই নিয়ম।প্রথম এ হাজব্যান্ড আসবে তারপর ওর রেসিডেন্ট কার্ড হলে তবেই ফ্যামিলি আনতে পারবে।আর তখন আমার ছেলের স্কুল ও ছিল তাই আমাদের আসতে আরো একটু দেরি হয়ে গেছিল।অনেক দিন পর আবার আমাদের চার জনের নতুন করে পথ চলা শুরু হলো,ভগবানের আশীর্বাদে যা আজ ও চলছে।
ওই অ্যাপার্টমেন্ট এ bacheler রা থাকত তাই রান্নাঘর খুব ই অপরিচ্ছন্ন ছিল,ফ্রিজ ভর্তি শুধু শুকনো কারি পাতা য় ভর্তি।অগত্যা লেগে পড়লাম সব পরিষ্কার করতে।
তবে হ্যাঁ! ঢুকেই যা ঘটলো কি বলবো! আমাদের গাড়ির যিনি ড্রাইভার ছিলেন তিনি আমার ছেলেকে আদর করতে গিয়ে এমন উল্টে পাল্টে দিয়েছেন যে ওর নাক দিয়ে গলগল করে সে কি রক্ত যে বেরিয়েছিল,বাপ রে! ওর একটু এই সমস্যা টা ছিল ,এটাকে নাকসির বলে দিল্লীতে জেনেছিলাম।অনেক টা বড়ো হবার পর ঠিক হয়েছে।যাক গে সে সব সামলে,আমি আর আমার হাজব্যান্ড বসে প্ল্যান করতে লাগলাম যে কি কি কিনতে হবে, মানে সাংসারিক জিনিস পত্র কি কি লাগবে সেই ব্যাপারে।তখন এখানকার দাম সম্বন্ধে কোনো আইডিয়াই ছিল না।দু একদিন পর আমি যখন গেলাম বাজার করতে জিনিসের দাম যেই টাকায় হিসেব করছি আমার তো হার্ট ফেল হবার জোগাড়! ইন্ডিয়ার থেকে অনেক অনেক বেশী।তখন ১ omani রিয়াল=১০০ টাকা ছিল। ব্যাস সেই মত হিসেব করছি আর আঁতকে উঠছি।
এবার এই মোটামুটি এক মাস পর থেকে শুরু হল আমাদের প্রথম যুদ্ধ।সেটা কি? সেটা ছিল আমাদের বাজেট এর মধ্যে একটা বাড়ি পাওয়া।এখানে আসার আগে আমরা যা জেনে এসেছিলাম,আর যা আসলে দেখলাম তাদের কোনো মিল ই ছিল না।২০০৭ এ সেপ্টেম্বরে মাস্কাট এ গনু বলে একটা সাইক্লোন হয়,যার ফলে এই অক্টোবর থেকে সমস্ত বাড়ি ভাড়া বেড়ে প্রায় ৩ গুন হয়ে গিয়েছিল।তখন একটা ১ বেডরুম ফ্ল্যাট ৪২৫ রিয়াল চাইছিল।আমাদের বাজেটের একদম বাইরে।তো কি করব বুঝতে পারছি না,মন টাও বেশ খারাপ করছিল।কতবার ভেবেছি বাড়ি না পেলে আমি বাচ্ছাদের নিয়ে আবার ইন্ডিয়া ফিরে যাব।ভগবান কেও ডাকছি যে একটা ভালো বাড়ি পাইয়ে দেবার জন্য,তো ওনার বোধ হয় আমাদের অবস্থা দেখে দয়া হয়েছিল।আমরা একটা একদম নতুন ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম ৩৫০ রিয়াল এ।যদিও এই ভাড়া টাও আমাদের রেঞ্জ এর বাইরেই ছিল।পরে বন্ধুদের কাছে শুনে ছিলাম ওরা ২ বেডরুম বাড়ি ১২০ রিয়াল ভাড়া দেয়,যেমন টা আমরা জেনে এসেছিলাম।কিন্ত ওরা আরো ১১/২ বছর আগে এসেছে এটা তেই এত তফাৎ।এর ফলে কি হল ,না আমাদের অন্যান্য খরচের সঙ্গে ভীষন কষ্ট করে আপস করতে হল।সংসার চালাতে তখন যে কি কষ্ট হয়েছে মনে হয় বোঝা যাচ্ছে।কারণ এতটা বাড়ি ভাড়ার কথা আগে জানলে আমার হাজব্যান্ড অফিসের সঙ্গে সেই ভাবেই negotiate করে আসত। আর খাঁ রার মধ্যে শুলের ঘা ছিল এর মধ্যে আমার ছেলের স্কুলের মাইনে।আসলে এখানে আসার আগে আমার হাজব্যান্ড জানত যে স্কুল ফিজ অফিস দেবে কিন্ত আসল সময় তে দেখা গেল যে না ওটা আমাদের কেই দিতে হবে ।এটা এত unexpected খরচ ছিল নিশ্চই আর বলে দিতে হবে না।
আমার তখন ওর ওপর যে কি রাগ হচ্ছিল কি বলব! কারণ আমরা দিল্লী তে তো আর জল এ পরে ছিলাম না ,ও ভাল জব করতো ,তাহলে কি দরকার ছিল এই অনিশ্চিত জীবন বেছে নেবার।আমরা আসার আগে ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করার বেশ অনেক ধাপ পেরিয়ে গিয়ে ছিল কিন্ত সংসার শুরু করার পর এই সমস্ত খরচ চালিয়ে ড্রাইভিং শেখার পয়সার সংকুলান হতো না তাই ফল স্বরূপ ও ড্রাইভিং শেখাতে তখনকার মত ইতি টানল( মাস্কাট এ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া ভীষন শক্ত আর এক্সপেন্সিভ) ।এক এক বার ফেল করলে পুরো পয়সা জল এ।আর লাইসেন্স করতে গিয়ে ৬/৭ বার ফেল করা কোনো ব্যাপার ই নয়।এক বার ফেল করা মানে টেস্ট এর ৫০০০ টাকা জল এ।উফফ! কি যে গেছে সেই সব দিন বিদেশ বিভূঁইয়ে।
তাই তখন মাইনের টাকায় সংসারের খরচ চালিয়ে আরো এক্সট্রা ৫০ রিয়াল করে বার করা একেবারেই অসম্ভব ছিল।
ক্রমশঃ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন